দেশের অন্যতম রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এবং তাদের ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরকে নিষিদ্ধ করে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় নেওয়া সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করা হয়েছে।
এ সংক্রান্ত গেজেট বুধবার (২৮ আগস্ট) প্রকাশ করা হতে পারে।
গতকাল সুপ্রিম কোর্টের অ্যানেক্স ভবনের সামনে এক সংবাদ সম্মেলনে দলটির আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির বলেছিলেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী মঙ্গলবার (আজ) বা দ্রুততম সময়ের মধ্যে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার হচ্ছে। একইসঙ্গে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের পর আপিল বিভাগে জামায়াতের নিবন্ধ সংক্রান্ত আপিলটি পুনরায় শুনানির জন্য আবেদন করা হবে।
তিনি বলেন, জামায়াত আইনি পদক্ষেপ অনুযায়ী পথ চলতে চায়। গত ৫ আগস্ট তৎকালীন ফ্যাসিবাদী সরকারের পতন হয়। ওই দিনই সেনাপ্রধানের অফিস ও বঙ্গভবনে রাজনৈতিক দলের সভা অনুষ্ঠিত হয়। দেশের অন্যতম রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামিকে সেখানে আনুষ্ঠানিকভাবে আমন্ত্রণ জানানো হয়। অতঃপর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ গঠনের ক্ষেত্রেও জামায়াত তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। জামায়াত রাষ্ট্র সংস্কার প্রক্রিয়ায় ক্রমাগত অংশগ্রহণ করে যাচ্ছে। গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে আইন-শৃঙ্খলার উন্নতি, মন্দির পাহারা, শহীদ পরিবার ও আহত-পঙ্গুদের পাশে দাড়ানো ও বন্যা-দুর্গতের মানবিক সহায়তা প্রদান তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য।
শিশির মনির আরও বলেন, ১২ আগস্ট প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে জামায়াতের আনুষ্ঠানিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকের আলোচনা অনুযায়ী এই বিষয়ে আইনগত দিক খতিয়ে দেখা হয় এবং আশু সমাধানের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। সরকারের সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে একাধিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। আইনি বিধানগুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। এরই প্রেক্ষিতে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে ১৯ ধারা অনুযায়ী আইনগত পদক্ষেপ নেওয়া হয়। অতঃপর আইন অনুযায়ী সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় কর্তৃক তিন সদস্যবিশিষ্ট প্যানেল গঠন করা হয়। আমাদের তথ্য অনুযায়ী ইতোমধ্যে এই সংক্রান্তে যথাযথ প্রশাসনিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়েছে। সরকারের সিদ্ধান্ত মোতাবেক দ্রুততম সময়ের মধ্যে নিষিদ্ধের আদেশ বাতিল করে নতুন গেজেট প্রকাশিত হবে।
এর আগে গত ১ আগস্ট সন্ত্রাসবিরোধী আইনের ১৮ এর ১ ধারা অনুযায়ী নির্বাহী আদেশে জামায়াত, শিবির ও এর অন্যান্য অঙ্গ সংগঠনকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে প্রজ্ঞাপন জারি করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, যেহেতু, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক প্রদত্ত কয়েকটি মামলার রায়ে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী (পূর্বনাম জামায়াত-ই- ইসলামী/জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ) এবং তার অঙ্গ সংগঠন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির (পূর্বনাম ইসলামী ছাত্রসংঘ)-কে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালে সংঘটিত গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধে দায়ী হিসেবে গণ্য করা হইয়াছে; এবং যেহেতু, বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ রিট পিটিশন নং-৬৩০/২০০৯-এ ১ আগস্ট ২০১৩ তারিখের প্রদত্ত রায়ে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এর রাজনৈতিক দল হিসেবে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন কর্তৃক প্রদত্ত/প্রাপ্ত নিবন্ধন বাতিল করিয়া দিয়াছে এবং বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ, হাইকোর্ট বিভাগের ওই রায়কে বহাল রাখিয়াছে; এবং যেহেতু, সরকারের নিকট যথেষ্ট তথ্য প্রমাণ রহিয়াছে যে, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এবং তার অঙ্গ সংগঠন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির সাম্প্রতিককালে সংঘটিত হত্যাযজ্ঞ, ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে সরাসরি এবং উসকানির মাধ্যমে জড়িত ছিল।
এতে আরও বলা হয়েছে, যেহেতু সরকার বিশ্বাস করে যে, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এবং বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরসহ উহার সব অঙ্গ সংগঠন সন্ত্রাসী কার্যকলাপের সহিত জড়িত রহিয়াছে সেহেতু, সরকার, সন্ত্রাস বিরোধী আইন, ২০০৯ এর ধারা ১৮(১) এ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এবং বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরসহ তার সব অঙ্গ সংগঠনকে রাজনৈতিক দল ও সংগঠন হিসাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করিল এবং উক্ত আইনের তফসিল-২ এ বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরসহ তার সব অঙ্গ সংগঠনকে নিষিদ্ধ সত্ত্বা হিসেবে তালিকাভুক্ত করিল। ইহা অবিলম্বে কার্যকর হইবে।
সন্ত্রাসবিরোধী আইন-২০০৯ এর ১৮ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘এই আইনের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে, সরকার, কোনো ব্যক্তি বা সত্তা সন্ত্রাসী কার্যের সহিত জড়িত রহিয়াছে মর্মে যুক্তিসঙ্গত কারণের ভিত্তিতে, সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা, উক্ত ব্যক্তিকে তফসিলে তালিকাভুক্ত করিতে পারিবে বা সত্তাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা ও তফসিলে তালিকাভুক্ত করিতে পারিবে।’
আইনে সন্ত্রাসী কাজের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি, সত্তা বা বিদেশি নাগরিক বাংলাদেশের অখণ্ডতা, সংহতি, জননিরাপত্তা বা সার্বভৌমত্ব বিপন্ন করার জন্য জনসাধারণ বা জনসাধারণের কোনো অংশের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টির মাধ্যমে সরকার বা কোন সত্তা বা কোনো ব্যক্তিকে কোনো কাজ করতে বা করা থেকে বিরত রাখতে বাধ্য করার জন্য অন্য কোনো ব্যক্তিকে হত্যা, গুরুতর আঘাত, আটক বা অপহরণ করে বা করার চেষ্টা করে, এ ধরনের কাজের জন্য অন্য কারো সঙ্গে ষড়যন্ত্র বা সহায়তা বা প্ররোচিত করে; অথবা অন্য কোনো ব্যক্তি, সত্তা বা প্রজাতন্ত্রের কোনো সম্পত্তির ক্ষতি করে বা করার চেষ্টা করে; অথবা ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে ষড়যন্ত্র বা সহায়তা বা প্ররোচিত করে; অথবা এ ধরনের উদ্দেশ্য নিয়ে কোনো বিস্ফোরক দ্রব্য, দাহ্য পদার্থ ও আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে বা নিজ দখলে রাখে, কোনো সশস্ত্র সংঘাতময় দ্বন্দ্বের বৈরি পরিস্থিতিতে অংশ নেয়, তাহলে তা ‘সন্ত্রাসী কাজ’ বলে গণ্য হবে। এ আইনে কোনো অপরাধ প্রমাণিত হলে সর্বোচ্চ মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়েছে।