পৃথিবীর প্রতিটি বাজারে পণ্যের দাম নির্ভর করে পণ্যের ডিমান্ড এবং সাপ্লাইয়ের উপর। পুঁজিবাজারও এর ব্যাতিক্রম নয়। ২০১০ সালে পুঁজিবাজার ধ্বসের পর নিয়ন্ত্রণ সংস্থা পুঁজিবাজারে একের পর এক নুতন কোম্পানি তালিকাভুক্ত করে বাজারের সাপ্লাই বৃদ্ধি করলেও কোন ধরনের ডিমান্ড তৈরি করতে পারেনি।
নুতন কমিশন দায়িত্ব নেয়ার পর কমিশনের নুতন চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম নিজের মুখেই বলেছিলেন বর্তমানে পুঁজিবাজারে ডিমান্ডের চেয়ে সাপ্লাই বেশি তাই আমরা আগে ডিমান্ড তৈরি করবো তারপর সাপ্লাইয়ের কথা চিন্তা করবো। কিন্তু বাস্তবে আমরা এর বিপরীত চিত্র দেখতে পেলাম। যদিও এর কারণ উনি ব্যাখ্যা করেছেন।
তার ভাষ্যমতে বিগত কমিশনের সময় পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হবার জন্য অনেক গুলো কোম্পানির আবেদন তাদের কাছে জমা ছিল। সেগুলোর মধ্যে যে কোম্পানিগুলো যোগ্যতা সম্পূর্ণ বর্তমান কমিশন শুধু সেই কোম্পানিগুলোকে তালিকাভুক্ত হওয়ার অনুমোদন দিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে বাজারে যেখানে এক তৃতীয়াংশ কোম্পানির ক্রেতা নেই সেখানে একের পর এক আইপিও অনুমোদনের সাপেক্ষে চেয়ারম্যান মহোদয় যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন তা কোন ভাবেই যুক্তিসঙ্গত নয়। নুতন কমিশন এখানে কোম্পানির স্বার্থকে বেশি প্রাধান্য দিয়েছে।
গত ৬ মাসে নুতন করে ১২টি কোম্পানি তালিকাভুক্ত করে নুতন রেকর্ড তৈরি করে ফেলেছে নুতন কমিশন। আর এই ১২টি কোম্পানির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ টাকা বাজার থেকে বের হয়ে গেছে। আমরা সবাই জানি যারা আইপিও করে তাদের বেশিরভাগ ব্যাক্তির সেকেন্ডারি মার্কেটে বিনিয়োগ নেই। যার ফলে আইপিও হান্টাররা কোম্পানি তালিকাভুক্ত হবার কয়েক দিনের মধ্যে উচ্চ মূল্যে শেয়ার বিক্রি করে বাজার থেকে টাকা নিয়ে চলে যায়। আর সেকেন্ডারি মার্কেট হয়ে পড়ে রক্ত শুন্য।
গত ৬ মাসে যে কোম্পানি গুলো তালিকাভুক্ত হয়েছে তার একটি তালিকা এবং সেই কোম্পানিগুলোর উচ্চ মূল্য এবং বর্তমান মূল্য তুলে ধরলামঃ-
১) এক্সপ্রেস ইন্স্যুরেন্স লিমিটেডঃ কোম্পানিটি তালিকাভুক্ত হবার পর এর দাম ৪৬ টাকা উঠে যায়। বর্তমানে শেয়ারটি ২৪ টাকায় অবস্থান করছে।
২) এসোসিয়েটেড অক্সিজেন লিমিটেডঃ কোম্পানিটি তালিকাভুক্ত হবার পর টানা বাড়তে বাড়তে ৬৬ টাকা উঠে যায়। বর্তমানে শেয়ারটি ৩৫ টাকায় অবস্থান করছে।
৩) ডমিনেজ স্টিল বিল্ডিং সিস্টেমস লিমিটেডঃ কোম্পানিটি তালিকাভুক্ত হবার পর টানা বাড়তে বাড়তে ৪৩ টাকা উঠে যায়। বর্তমানে শেয়ারটি ২০ টাকায় অবস্থান করছে।
৪) ক্রিস্টাল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডঃ কোম্পানিটি তালিকাভুক্ত হবার পর টানা বাড়তে বাড়তে ৫৭ টাকা উঠে যায়। বর্তমানে শেয়ারটি ৩৪ টাকায় অবস্থান করছে।
৫) রবি আজিয়াটা লিমিটেডঃ কোম্পানিটি তালিকাভুক্ত হবার পর টানা বাড়তে বাড়তে ৭৭ টাকা উঠে যায়। বর্তমানে শেয়ারটি ৪৪ টাকায় অবস্থান করছে।
৬) ওয়ালটন হাই টেক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডঃ বর্তমানে শেয়ারটি ১২০০ টাকায় অবস্থান করছে।
৭) এনার্জিপ্যাক পাওয়ার জেনারেশন লিমিটেডঃ কোম্পানিটি তালিকাভুক্ত হবার পর টানা বাড়তে বাড়তে ১০১ টাকা উঠে যায়। বর্তমানে শেয়ারটি ৪৩ টাকায় অবস্থান করছে।
৮) ই-জেনারেশন লিমিটেডঃ কোম্পানিটি তালিকাভুক্ত হবার পর টানা বাড়তে বাড়তে ৪৩ টাকা উঠে যায়। বর্তমানে শেয়ারটি ২৭ টাকায় অবস্থান করছে।
৯) তৌফিকা ফুডস অ্যান্ড অ্যাগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডঃ কোম্পানিটি তালিকাভুক্ত হবার পর টানা বাড়তে বাড়তে ২৭ টাকা উঠে যায়। বর্তমানে শেয়ারটি ২১ টাকায় অবস্থান করছে।
১০) মীর আক্তার হোসেন লিমিটেডঃ কোম্পানিটি তালিকাভুক্ত হবার পর টানা বাড়তে বাড়তে ১১৭ টাকা উঠে যায়। বর্তমানে শেয়ারটি ৬৭ টাকায় অবস্থান করছে।
১১) লুব-রেফ (বাংলাদেশ) লিমিটেডঃ কোম্পানিটি তালিকাভুক্ত হবার দ্বিতীয় দিনেই ৬১ টাকা উঠে যায়। ৫ দিনের ব্যবধানে বর্তমানে শেয়ারটি ৩৬ টাকায় অবস্থান করছে।
১২) এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক লিমিটেড: গত সোমবার তালিকাভুক্ত হয়ে ১৫ টাকা উঠে ৩ দিনের ব্যবধানে বর্তমানে শেয়ারটি ১১.৬ টাকায় অবস্থান করছে।
গত ৬ মাসে আইপিওর মাধ্যমে কয়েক হাজার কোটি টাকা বাজার থেকে বের হয়ে গেছে। শুধু মাত্র রবি থেকেই হাজার কোটি টাকা বাজার থেকে বের হয়ে গেছে। পুঁজিবাজারে রবি ৫২ কোটি শেয়ার ছাড়ে। ১০ টাকা মূল্যের সেই শেয়ার ৪০ টাকায় লেনদেন শুরু হলেও বেশির ভাগ শেয়ার লেনদেন হয় ৫০ টাকা উপরে অর্থাৎ ৫ গুন দামে। ৫২ কোটি শেয়ারের ৫০% অর্থাৎ ২৬ কোটি শেয়ারও যদি আইপিও হান্টাররা ৫০ টাকায় বিক্রি করে বাজার থেকে টাকা তুলে নেয় তাহলে তার বাজারমূল্য দাঁড়ায় ১৩০০ কোটি টাকা। এছাড়াও এনার্জিপ্যাক পাওয়ার জেনারেশন লিমিটেড কোম্পানিটি তালিকাভুক্ত হবার পর বেশিরভাগ শেয়ার লেনদেন হয় ১০১ টাকায় প্রায় ১ কোটি শেয়ার যার বাজারমূল্য প্রায় ১০০ কোটি টাকা। বর্তমানে শেয়ারটি ৪৩ টাকায় অবস্থান করছে।
১০ বছর আগে যখন আইপিওতে কোন কোম্পানি বাজারে তালিকাভুক্ত হতো তখন প্রথম দিকে শেয়ার গুলোর দাম কম থাকতো। পরবর্তীতে আইপিও হান্টাররা যখন তাদের শেয়ারগুলো বিক্রি করে দিত তারপর শেয়ারগুলোর দাম বাড়ত।
কিন্তু গত ১০ বছরে আমরা এর বিপরীত চিত্র দেখতে পাই। গত ১০ বছরে আইপিওতে কোন কোম্পানি তালিকাভুক্ত হলে প্রথম কয়েকদিনেই শেয়ার গুলো ৫ থেকে ১০ গুন দামে লেনদেন শুরু হয়, এরপর সময়ের সাথে সাথে দাম কমতে কমতে ফেস ভ্যালুতে চলে আসে। লেনদেন শুরুর প্রথম কয়েক দিনে ৫ থেকে ১০ গুন দামে শেয়ার গুলো লেনদেনের পেছনে কয়েকটি দুষ্ট চক্র জড়িত। যাদের মধ্যে প্লেসমেন্ট হান্টার এবং প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী অন্যতম।
অনেকেই মনে করেন আইপিও পুঁজিবাজারের প্রাণ। কোম্পানি গুলো অর্থ সংগ্রহ করে আইপিও থেকে তাই আইপিও বন্ধ করা যাবে না। কিন্তু একটি কথা ভুলে গেলে চলবে না আর তা হলো সেকেন্ডারি মার্কেটে আইপিওতে আসা শেয়ার গুলো বিক্রির ব্যবস্থা না থাকলে আইপিওর শেয়ারের জন্য ১টিও আবেদনকারী খুজে পাওয়া যাবে না। তাই বাজার সংশ্লিষ্ট সকল মহলকে বলবো আগে সেকেন্ডারি মার্কেটে ডিমান্ড তৈরি করুন। সেকেন্ডারি মার্কেটের বিনিয়োগকারীরা বাঁচলে পুঁজিবাজার বাঁচবে। অন্যথায় গত ১০ বছরের মতন এই পুঁজিবাজার খুড়িয়ে খুড়িয়ে চলবে। একটি প্রানবন্ত পুঁজিবাজারের স্বপ্ন শুধু স্বপ্নই থেকে যাবে।
বর্তমান কমিশন দায়িত্ব নেয়ার পর অনেক গুলো ভালো সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যার জন্য তাদের ধন্যবাদ দিতেই হয়। এখন সেই সিদ্ধান্ত গুলো যদি সঠিক ভাবে পরিপালন করা হয় তবে বাজার আবার ঘুরে দাঁড়াবে।
ভাল সিদ্ধান্তগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে:
আইপিওতে কোটার পরিবর্তনঃ গত ১০ বছর আইপিওতে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীর কোটা ৫০% ছিল। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগের অনেক পথ রয়েছে তাই আইপিও থেকে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের জন্য যে বিশেষ সুবিধা দেয়া হচ্ছিল তা কোন ভাবেই যুক্তিসঙ্গত ছিল না। বর্তমান কমিশন প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীর কোটা কমিয়ে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের জন্য ৮০% করে দিয়েছেন।
বর্তমান কমিশনের আরও একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত হচ্ছে আইপিওতে আবেদন করতে হলে সেকেন্ডারি মার্কেটে নুন্যতম ২০ হাজার টাকার বিনিয়োগ থাকতে হবে। বিএসইসির এই সিদ্ধান্তের ফলে প্রাইমারি মার্কেটে আইপিও হান্টারদের দৌরাত্ম্য কমে আসবে। পাশাপাশি বাজারে নুতন করে টাকা ঢুকবে।
বর্তমান কমিশনের আরও একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত হচ্ছে বিনিয়োগকারীদের জন্য ইন্টারেস্ট রেট ১২% নির্ধারণ করে দেয়া। বর্তমানে মার্চেন্ট ব্যাংক এবং ব্রোকারেজ হাউজ গুলো বিনিয়োগকারীদের কাছে থেকে ১৭% থেকে ১৮% ইন্টারেস্ট নিয়ে থাকে। যেখানে বর্তমানে অধিকাংশ ব্যাংক ৬% থেকে ৭% ইন্টারেস্টে লোন দিচ্ছে সেখানে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের কাছে থেকে উচ্চ হারে সুদ নেয়াটা অমানবিক। এই উচ্চ সুদের গ্যারাকলে পড়ে অনেক বিনিয়োগকারী নিঃস্ব হয়ে গেছে।
বর্তমানে করোনার কারণে সকল ধরনের বিনিয়োগ বন্ধ। মানুষ নুতন করে বিনিয়োগ করছে না। ব্যাংক ইন্টারেস্ট কমতে কমতে ২% এসে দাঁড়িয়েছে। ব্যাংক গুলোতে প্রচুর পরিমানে অলস অর্থ পড়ে আছে। ব্যাংক গুলো এখন ৫% ইন্টারেস্টেও লোন দেয়ার জন্য গ্রাহক খুজে বেড়ায়। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের পুঁজিবাজার চাঙ্গা হওয়া ছাড়া বিকল্প কোন পথ নেই। বর্তমান পরিস্থিতিতে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করা ছাড়া দ্বিতীয় কোন পথ খোলা নেই বড় বড় বিনিয়োগকারীদের কাছে। আর সেই কারনে ভারত সহ বিশ্বের বড় বড় পুঁজিবাজার গুলো একের পর এক নুতন উচ্চতার রেকর্ড গড়ে যাচ্ছে। গত ৬ মাসে বাংলাদেশের পুঁজিবাজার ঘুরে দাঁড়ানোর পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে ব্যাক্তি বিনিয়োগকারীরা। তাই ব্যক্তি বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষা করা গেলে বাংলাদেশের পুঁজিবাজারও সামনের দিন গুলোতে ভারতের পুঁজিবাজারের মতন নুতন উচ্চতায় গিয়ে দাঁড়াবে। সংগৃহীত
লেখক : মাসুদ হাসান
পুঁজিবাজার বিশ্লেষক