পুঁজিবাজারে বড় দরপতন ঠেকাতে ফ্লোরপ্রাইস আরোপ করেছিল বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষার দোহাই দিয়ে এ ব্যবস্থা নিয়েছিল বিএসইসি। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) ব্রড ইনডেক্স ডিএসইএক্স ৬ হাজার পয়েন্টের নিচে নেমে গেলে তড়িঘড়ি করে এ ব্যবস্থা নেওয়া হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী তথা বাজারকে ওই তেতো স্বাদ নিতেই হল। প্রায় দেড় বছর ফ্লোরপ্রাইসের মাধ্যমে মূল্যসূচক তথা দরপতন আটকে রাখা গেলেও তা প্রত্যাহারের কিছুদিনের মধ্যেই ফ্লোরপ্রাইসের আগের অবস্থানে ফিরে গেল বাজার।
ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাব ও রাজনৈতিক অদূরদর্শিতায় ২০২২ সালে শ্রীলংকার অর্থনীতি চরম সঙ্কটে পড়ে। দেশটি নিজেকে দেওলিয়া ঘোষণা করে। ওই সময় প্রচণ্ড চাপে থাকা বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়েও নানা গুজব ও আতঙ্ক ছড়াতে থাকে। বাংলাদেশের অবস্থাও শ্রীলংকার মতো হতে পারে এমন আশঙ্কার মুখে টানা দরপতন শুরু হয় দেশের পুঁজিবাজারে। এরই একপর্যায়ে ২০২২ সালের ২৮ জুলাই ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) ব্রড ইনডেক্স ডিএসইএক্স ৬ হাজার পয়েন্টের নিচে নেমে যায়। সূচকটির অবস্থান দাঁড়ায় ৫ হাজার ৯৮০ পয়েন্ট। ওইদিন বিকালে বিএসইসি বাজারে শেয়ারের নিম্নসীমা বা ফ্লোরপ্রাইস আরোপ করে। জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে এ ব্যবস্থা নেওয়া হলেও বিএসইসির দাবি ছিল, ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের পুঁজিকে সুরক্ষার দেওয়ার লক্ষ্যে এ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
ফ্লোরপ্রাইস আরোপের ফলে বাজারে লেনদেন একেবারেই কমে যায়। বেশিরভাগ কোম্পানির শেয়ার দিনের পর দিন ক্রেতাশূন্য থাকে। লেনদেন কমে যাওয়ায় ব্রোকারহাউজ ও মার্চেন্ট ব্যাংকের আয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। অন্যদিকে বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ আটকে যায়। অতি জরুরি প্রয়োজনেও তারা শেয়ার বিক্রি করে টাকা নিতে পারেননি। অসংখ্য বিনিয়োগকারীকে দুঃসহ এক পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হয়।
এদিকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দেড় মাসের মাথায় ৩৫টি বাদে সব কোম্পানির ফ্লোরপ্রাইস তুলে নেয় বিএসইসি। পরে আরও কয়েকটি কোম্পানির শেয়ারের উপর থেকে ফ্লোর তুলে নেওয়া হয়। এর কিছুদিনের মধ্যেই বাজারে টানা পতন শুরু হয়। আজ বুধবার টানা পঞ্চম দিনের মতো দরপতন হয় বাজারে। দিনশেষে সূচক নেমে আসে ৫ হাজার ৯৭৪ পয়েন্টে, যা ফ্লোরপ্রাইস আরোপের দিনের চেয়েও প্রায় ৬ পয়েন্ট কম।
২০২২ সালে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের দোহাই দিয়ে ফ্লোরপ্রাইসের মতো বিকৃত ব্যবস্থা নিলেও, এখন বাজার পরিস্থিতি তারচেয়ে খারাপ হওয়া সত্ত্বেও তাদের পাশে নেই। নেই বাজারে তারল্য বা গতি বাড়ানোর কোনো উদ্যোগ।
গতকাল দেশের প্রথম বিজনেস নিউজ পোর্টাল অর্থসূচকে ‘সূচক কি ৬ হাজারের নিচে নেমে যাবে?’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। সেই প্রতিবেদনে বলা হয়েছিলো- দেশের পুঁজিবাজারের বেশিরভাগ বিনিয়োগকারী ৬ হাজার পয়েন্টকে একটি মনস্তাত্ত্বিক বাধা হিসেবে বিবেচনা করে আসছেন। এতদিন পর্যন্ত তারা মনে করতেন, বাজারে নানা মাত্রায় উঠা-নামা থাকলেও সূচক (ডিএসইএক্স) ৬ হাজারের নিচে নামবে না। তারা বিশ্বাস করতেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) সূচক ৬ হাজারের নিচে নামতে দেবে না।
‘সূচক কি ৬ হাজারের নিচে নেমে যাবে?’ – এ প্রশ্নের উত্তর আজ পাওয়া গেছে। কারণ ডিএসই’র প্রধান সূচক আজ ৬ হাজার থেকে ২৬ পয়েন্ট নিচে রয়েছে।
তবে সূচক ৬ হাজারের নিচে নামলেও বিনিয়োগকারীদেরকে আতঙ্কগ্রস্ত না হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, সূচকের হ্রাস-বৃদ্ধি পুঁজিবাজারের অতি স্বাভাবিক ঘটনা। বাজারে শেয়ারের দাম বেশি কমে গেলে নতুন ক্রেতা তৈরি হয়, নতুন বিনিয়োগকারীও আসে। তারা সক্রিয় হলে শেয়ারের দাম ও সূচক বৃদ্ধি পায়। এভাবে বাজারে এক ধরনের ভারসাম্য আসে। তাই বিনিয়োগকারীদের উচিত ধৈর্য ধারণ করা এবং কোম্পানির ভাল-মন্দ যাচাই করে বিনিয়োগ সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া।
তারা বাজারে বিএসইসির হস্তক্ষপেরও বিপক্ষে। অতীতে ফ্লোরপ্রাইস আরোপ, বাজারে বেশি দর পতন হলে ফোন করে ব্রোকারদেরকে শেয়ার বিক্রি করতে বারণ করা অথবা বেশি বেশি করে শেয়ার কিনে বাজারকে সাপোর্ট দেওয়ার মত নানা ব্যবস্থা নিয়েছে। এসব ব্যবস্থা বাজারের স্বাভাবিক গতিকে নষ্ট করে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, সূচক কোন দিকে যাচ্ছে তা না দেখে, বাজারে কোনো কারসাজি হচ্ছে কি-না, আইনের পরিপালন ঠিক আছে কি-না তার দিকে নজর দেওয়া বেশি জরুরী।